রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১০:০৫ পূর্বাহ্ন


সমাজ প্রতিষ্ঠায় চাই নৈতিক ও মানবিক শিক্ষা

সমাজ প্রতিষ্ঠায় চাই নৈতিক ও মানবিক শিক্ষা

শিক্ষা

শেয়ার বোতাম এখানে

ফারিহা হোসেন : আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় সনাতন মানসিকতার পরিবর্তে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। একই সঙ্গে চিন্তা চেতনা, ধ্যান ধারনা, আচার আচরণ ,রীতি নীতিতেও এসেছে পরির্বতন। বলতে গেলে সমাজের প্রতিটি স্তরে,পরিবারে সর্বত্রই ছোঁয়া লেগেছে পরিবর্তনের। তথ্য প্রযুক্তি,বিজ্ঞানের কল্যাণেই সম্ভব হয়েছে এই পরিবর্তন। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বার্থক বাস্তবায়নের পর এখন তিনি স্মার্ট বাংলাদেশ.স্মার্ট সোসাইট,স্মার্ট প্রশাসন.স্মার্ট নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য বাস্তবায়নে কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছেন। উন্নত বিশে^র সঙ্গে তাল মেলাতে,উন্নত জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বিজ্ঞানের নব নব এসব উপকরনের সঙ্গে , প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে চলতে না পারলে মানুষ হিসেবে আমরা পিছিয়ে পড়বো। কাজেই যুগের সঙ্গে, প্রযুক্তির সঙ্গে, পরিবর্তিত বিশ^ ব্যবস্থার সঙ্গে আমরা যুক্ত হবো।

তবে আমাদের শিক্ষা,আমাদের জীবন ব্যবস্থার সঙ্গে মানবিকতা,সামাজিকতা ,লৌকিকতা,মমত্ববোধ,মনুষ্যত্বের বিকাশ,চর্চ্চা এবং লালন করার মধ্য দিয়েই দেশকে,সমাজকে, পরিবারকে,নিজেকে এগিয়ে নেয়ার মধ্যেই রয়েছে মানব জন্মের স্বার্থকতা। অর্থ্যৎ মানবতা ,মানবিকতা .মনুষ্যত্বের সঙ্গে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের সংযোগ হলে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। এবং তখনই সমাজ,দেশ.মানুষ উপকৃত হবে একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত স্মাট বাংলাদেশ টেকসই,লগসই এবং জনবান্ধব,মানবিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।

এসব বিষয় প্রাসঙ্গিক এ কারণেই যে আমরা যতটা বিজ্ঞান মনস্ক হচ্ছি,আধুনিক হচ্ছি,প্রযুক্তি নির্ভর হচ্ছি ততটাই মানবিকতা,মনুষ্যত্ব বোধ লোপ পাচ্ছে,সমাজ থেকে সামাজিকতা,সহনশীলতা,সহমর্মিতা, লৌকিকতা,বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা,সম্মানবোধ,ছোটদের প্রতি আদর,স্নেহ,মায়া মমতা, আদপ কায়দা ক্রমশ: লোপ পাচ্ছে। এর বিশেষ কিছু কারণ রয়েছে। বর্তমান পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের ধ্যান ধারনা,চিন্তায়ও পরিবর্তন এসেছে। পিতা মাতা,অভিভাবকদের মানসিকতার পরিবর্তনের ফলে তাদের সন্তানদের সুশিক্ষা,নৈতিক শিক্ষা,মানবিক শিক্ষার পরিবর্তে কেতাবী শিক্ষা,সাটিফিকেট সর্বস্ব শিক্ষায় প্রলুদ্ধ করছে তাদের সন্তানদের। এ অবস্থায় কোন পরিবারে একটা সন্তান পৃথিবীতে ভ‚মিষ্ট হওয়ার পর বয়স বৃদ্ধির শুরু থেকেই নিজ পরিবার এবং সমাজের লোকদের কাছ থেকে নীতি,নৈতিকতা,আদর্শ,মানবিক,সামাজিকতা,লৌকিকতা বা উপদেশ মূলক বা পরামর্শ মূলক কথা শুনতে পায়না। বরং কার সন্তান কত শিক্ষিত হলো, পরীক্ষায় কি রেজাল্ট হলো, কে কোথায় পড়ে,পড়া শেষে কি করবে .কার ছেলে বিজ্ঞানী হলো,ইঞ্জিনিয়ার হলো ইত্যাকার বিষয়ই মুখ্য হয়ে ওঠে। আত্নীয় স্বজন,বন্ধু বান্ধাব, পাড়া প্রতিবেশীর মুখেও প্রতিনিয়ত শুনতে হয় এসব কথা।

কিন্তু এই শিক্ষার সাথে সত্যিকারের মানুষ হওয়া.মানবিক মানুষ হওয়ার বিষয়ে কোন কথা শুনতে পাওয়া যায়না। এটা দু:খজনক। যদি আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মকে মানবিক এবং সুশিক্ষা দিয়ে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি তাহলে সমাজ,দেশ,মানুষ উপকৃত হবে। একই সঙ্গে মানবিক রাষ্ট্র,মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে।

বাস্তবতা হচ্ছে: নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে শোনা যায়, তোমার রেজাল্ট কি? কত তম হয়েছ? বড় হয়ে তুমি কি হতে চাও, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন কি? কি! তুমি এখনো সিদ্ধান্তই নিতে পারলে না, কি করবে তোমার ভবিষ্যতে! কি সাবজেক্ট নিয়ে পড়ছ? চাকরি করছো তো? চাকরির বয়স চলে যাচ্ছে তোমার। মাসিক আয় কত তোমার? আয় বাড়ানোর চিন্তা ভাবনা কি করো নাকি করো না? বিয়ে কবে করছ? বিয়ের বয়স পার হয়ে গেলে কিন্তু ভাগ্যে কেও জুটবে না। আরেকটু পরিশ্রম করলে কি এমন ক্ষতি হয়?

শৈশবে নানান স্বপ্নে মগ্ন থাকে প্রতিটি শিশু। তবে বড় হতে হতে বাস্তবতা সম্পর্কে একটু যখন ধারণা এসে যায়, সন্তানদের মাথায় তখন থেকেই একটু কথা শুনতে হয় বন্ধু.প্রতিবেশী,আত্নীয়দের কাছ থেকে। একটা শিশুকে যদি তার শৈশব থেকেই শিখানো হয়, “লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়ায় চড়ে সে”। যা সম্পূর্ণ ভুল এবং ভিত্তিহীন একটি উক্তি। সন্তানের জীবনে শুরু থেকেই যদি পিতা-মাতা মিথ্যা উক্তি ও যুক্তি দিয়ে তার জীবন সম্পর্কে ধারণা দিতে থাকে, তবে সেই সন্তানের ভবিষ্যৎ আসলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? সন্তানকে তার শৈশব থেকেই আমাদের সমাজের নিৎকৃষ্ট নিয়মরীতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া উচিৎ, তাদেরও জানা উচিৎ তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ,কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত হয়েই বড় হচ্ছে। আবার এও বলা হয়, “তুমি ছোট, তুমি বুঝবে না”। এই উক্তিটি থেকে যথাসাধ্য দূরে থাকাই শ্রেয়। ভবিষ্যতের সব কিছুই যদি শৈশবে নির্ধারণ করার অধিকার থাকে, তবে কেন ভবিষ্যৎ , ভবিষ্যতের বিষয়ে ,ভবিষ্যতেই নিদ্ধান্ত নেয়ার সময় ভবিষ্যতের উপর ছেড়ে দেয়াই উত্তম।

সন্তানদের পড়াশুনা এবং চাকরির ব্যাপারে শৈশব থেকে শুনতেই শুনতেই তাদের মস্তিষ্কে একটা ধারণা পুরোপুরিভাবে গেঁথে গিয়েছে যে, লেখাপড়ায় রেজাল্ট এবং তারপর চাকরিতে মাসিক আয় হলো আমাদের সব। কিছু আল্ট্রা লিজেন্ড ছেলে-মেয়ে আছে যারা শৈশবে স্বপ্ন দেখার প্রতি বিশ্বাসী থাকলেও পরবর্তীতে শুধু স্বপ্ন দেখার প্রতি সীমাবদ্ধ নয়, সেই স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দেয়ার প্রতি বিশ্বাসী হওয়ার। তারা ভবিষ্যৎ এর কথা চিন্তা না করে নিজের বর্তমান সময়কে বেশী অগ্রাধিকার দিলেও, পরবর্তীতে কিন্তু সেই আগের চিন্তায় ফিরে আসে। ভালোভাবে লেখাপড়া-ভালো একটা রেজাল্ট-ভালো একটা চাকরি-মাসিক আয় যথেষ্ট। কারণ তারা বুঝতে পারে, তাদের সঠিক চিন্তা-ভাবনা নিয়ে বড় হওয়া থেকে সমাজের মানুষ ভ্যালু দিবে “তোমার সেলারি কত?” এই উক্তিতে। তাই তারা নিজেদের খুব ভালোভাবেই সংশোধন করে নেয়। ব্যাস এই হলো আমাদের সুন্দর ও সুখী জীবন। বাইরে শত খুশির উল্লাস করে গেলেও, শিক্ষাির্থরা নিজের খুশির,পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করার জন্য তারা যা করতে বলেন,পড়কে বলেন,তাই তারা করে.তা তারা পড়ে। আমরা ভুলে যাই যে আমাদের সন্তানদেও ব্যক্তিগত পছন্দ,অপছন্দ,ভাল লাগা.মন্দ লাগা থাকতে পারে। বাস্তবে নতুন প্রজন্মের সন্তানদের মনে হাজারো স্বপ্ন ,হাজারো প্রশ্ন তাদের মনে,মসননে,অন্তরে জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। কিন্তু তার কিইবা মূল্য আছে তাদের অভিভাকদের মধ্যে।

এই সমাজ আমাদের একজন মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষের বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড় করায়। পরস্পর বন্ধু হয়েও শত্রæর মত লড়াই করে যেতে বাধ্য করে। আমরা কেন বুঝি না এই জীবন আমাদের? সৃষ্টিকর্তা আমাদের এত সুন্দর একটি জীবন দান করেছেন, সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ না জানিয়ে আমরা তাঁর সৃষ্টির অপব্যাবহার করছি। আমরা তো আমাদের প্রভুর দেয়া এত সুন্দর আমানতের খেয়ানতই করে যাচ্ছি দিন কে দিন! জীবনে বাঁচতে শিখতে হবে, বাঁচতে পারাটাই হলো আমাদের মূল লক্ষ্য। তারপর চিন্তা আসে কি করে আর কীভাবে বাঁচা যায়। জীবন হলো খুব সুন্দর একটা ভ্রমণক্ষেত্রে। তাই মানুষ ভ্রমণ যাত্রায় অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে।

আমাদের নিজ স্বত্বার প্রতি ভালোবাসার যেন কমতি না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে এই জীবন শুধুই একটি ভ্রমণ যাত্রা, কোনো প্রতিযোগিতা নয়। “জীবন যাত্রায় তুমি হেরে গিয়েছ”। এই উক্তিটি সমাজের লোকজনই বলে থাকে, আমাদের সৃষ্টিকর্তা কিন্তু কোনোদিন আমাদের বলেন নি এই কথা। তিনি যেমন সর্বদা আমাদের ওপর থেকে দেখছেন, ঠিক তেমনিভাবে আমাদের সর্বদা সুখে রাখার দায়িত্বও তাঁর। মাঝে মাঝে আমাদের জীবনে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়, নানান পরীক্ষা দিতে হয়।

তবে মনে রাখতে হবে, অন্ধকারের পরেই আলো ফিরে আসে,রাতের পর আসে দিন, আকাশে ওঠে সূর্য। যতই বাধা বিপত্তি থাকুক না কেন, সকলের জীবনে আলো এবং সফলতা একদিন আসবেই।আমরা যদি কষ্ট করি তার বিনিময়ে আমরা পুরষ্কারও পাব। তাই নিরাশ না হয়ে, মুখে হাঁসি রেখে, মনে প্রশান্তি নিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অবিরাম গতিতে ছুটে চলতে দেয়াই হবে উত্তম কাজ। তাই কেতাবী শিক্ষা,সাটিফিকেট নির্ভর শিক্ষার পরিবর্তে মানবকি ও নৈতিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেয়ার পাশাপাশি বিজ্ঞান মনস্ক জাতি গঠনে সকলকে মনোযোগ দেয়া আবশ্যক।

 

লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক,শিক্ষার্থি-নথ সাউথ বিশ^বিদ্যালয়।


শেয়ার বোতাম এখানে





LoveYouZannath
© All rights reserved © 2020 Shubhoprotidin